বৃহস্পতিবার, ০৪ মার্চ ২০২১, ১১:৫৭ পূর্বাহ্ন
অন্যদিগন্ত প্রতিবেদক ।।
ধকল কাটিয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল দেশের শেয়ারবাজার। ৫০ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়। বিভিন্ন শেয়ার থেকে মুনাফা তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজি হারানোর শঙ্কা ভুলে শেয়ারবাজার নিয়ে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখে নতুন নতুন বিনিয়োগকারীও ছুটে এসেছেন। হঠাৎ করেই শেয়ারবাজারের এ পরিস্থিতির ছন্দপতন ঘটেছে। উত্থানের বদলে এখন পতনই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। শেষ ১২ কার্যদিবসের মধ্যে সাতদিনই পতনের মধ্যে থেকেছে শেয়ারবাজার। আর লেনদেন কমতে কমতে সাতশ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে।
ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থেকে হঠাৎ শেয়ারবাজার এমন পতনের মধ্যে পড়ায় আবারও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে হুজুগে বা গুজবে কান না দিয়ে তথ্যনির্ভর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন বাজারে মূল্য সংশোধন চলছে। বিনিয়োগকারীরা প্যানিক না হলে শিগগির বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
তারা বলছেন, হঠাৎ করেই বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। বাড়তি দামে বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। আর বাড়তি দামে যারা ওই সব কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন, দাম কমে যাওয়ায় তারা এখন তা বিক্রি করতে পারছেন না। এ কারণে সার্বিক শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে গেছে। এছাড়া অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি কোম্পানির আইপিও আবেদনের ডেট পড়েছে। ফলে আইপিও ধরার জন্য বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন। এ কারণেও লেনদেন কমেছে। সেই সঙ্গে বিক্রির চাপে সূচক কমেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ধুকতে থাকা শেয়ারবাজারে মহামারি করোনাভাইরাস আতঙ্কে গত বছরের মার্চে বড় ধরনের ধস নামে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় শেয়ারবাজারের লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করার উদ্যোগ নেন। ফলে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন চালু হয়।
নতুন নেতৃত্বের অধীনে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়।
পরবর্তীতে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজন দুর্বল কোম্পানির আইপিও। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই ধরনের একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বাজারে সব থেকে তেজি ভাব দেখা যায়, ২০২০ সালের শেষ মাস ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে। এই দুই মাসে দফায় দফায় মূল্য সূচক বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে হু হু করে বাড়ে লেনদেন।
ডিসেম্বরের শুরুতে ছয়শ কোটি টাকার ঘরে থাকা ডিএসইর লেনদেন দেখতে দেখতে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। দেড় মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক এক হাজার পয়েন্ট বেড়ে যায়। শেয়ারবাজার এমন তেজি করে তুলতে বড় ভূমিকা রাখে রবি। শেয়ারবাজারে ২৪ ডিসেম্বর লেনদেন শুরু হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার দাম টানা ১৫ কার্যদিবস বাড়ে। এতে ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারের দাম ৭০ টাকায় উঠে যায়।
এমন তেজি হয়ে ওঠা শেয়ারবাজারে ছন্দপতন শুরু হয় ১৭ জানুয়ারি থেকে। এদিনই প্রথম রবির শেয়ার দামে পতন হয়। দফায় দফায় দাম কমে এখন কোম্পানিটির শেয়ার দাম ৫১ টাকায় নেমে এসেছে। রবির সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক শেয়ারবাজারের সূচকও নিচের দিকে নেমে গেছে। ১৪ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ছিল ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্টে, তা এখন (১ ফেব্রুয়ারি) ৫ হাজার ৫৯৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
অর্থাৎ ১২ কার্যদিবসেই ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক হারিয়েছে ৩১০ পয়েন্ট। আর দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে উঠে যাওয়া লেনদেন ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে সাতশ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। শেষ ১২ কার্যদিবসে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে ২৫ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলার শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ কমে গেছে।
শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিএসই’র এক সদস্য বলেন, রবি’র ১০ টাকার শেয়ার দাম দেখতে দেখতে ৭০ টাকা হয়েছে। এমন দাম বাড়ায় বড় বিনিয়োগকারীরা তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। আর যারা উচ্চ দামে শেয়ার কিনেছেন তারা দাম কমে যাওয়ায় বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে তাদের টাকা আটকে গেছে। যা সার্বিকভাবে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
শেয়ারবাজারের বর্তমান দরপতনের জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মো. রকিবুর রহমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) দায়ী করে বলেন, মার্জিন ঋণের সুদ হার কমানোর বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বিএসইসির চেয়ারম্যান মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন তা ঠিক হয়নি। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিক্রির কারণে বাজারের এখন এই অবস্থা।
তিনি বলেন, ২ হাজার ৭০০ কোটি (প্রকৃত ২ হাজার ৫০০ কোটি) টাকায় উঠে যাওয়া লেনদেন এখন সাতশ কোটি টাকায় নেমে এসেছে, এটা দুঃখজনক। উচ্চ দামে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বের হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন তারা (মার্চেন্ট ব্যাংক) দাম কমার অপেক্ষা করছে। দাম কমলে আবার কিনবে।
তিনি আরও বলেন, আমি আগে থেকেই বলে আসছি, একজন তিন বছরের বেশি মার্চেন্ট ব্যাংকের সিইও থাকতে পারবে না। কারণ একজন দীর্ঘদিন ধরে সিইও থাকলে তিনি একটি গ্রুপ সৃষ্টি করেন, যেখানে তার কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকে না। তাদের দিয়ে শেয়ার কিনে দাম বাড়ায়। দাম বাড়তে বাড়তে যখন একটা পর্যায়ে আসে, তখন তারা বাহির হয়ে যায়। আর দাম বাড়া দেখে যারা বিনিয়োগ করেন তারা ধরা খান।
রকিবুর রহমান বলেন, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান সব থেকে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি কেন ট্রেডারদের (মার্চেন্ট ব্যাংক) সঙ্গে কথা বললেন? কেন বললেন মার্জিন ঋণের সুদ হার অমুক মাস থেকে কার্যকর হবে। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো যখন বুঝতে পারছে, উচ্চ সুদ হার পাওয়া যাবে না, তখন তারা বাহির হয়ে গেছে। এখন কে দায়িত্ব নেবে?
শুধু কী মার্চেন্ট ব্যাংকের কারণে বাজারের এই অবস্থা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তো কারা? ট্রেড করেন ৩০-৪০ জন। মোট ট্রেডের ৮০ শতাংশ তাদের হাতে। গত ছয় মাসের বাজারের বেনিফিশিয়ারি কারা বিএসইসি এটা দেখলেই সব বেরিয়ে আসবে। কারা এই সময়ে বেরিয়ে গেছে, সেই রেকর্ড তো বিএসইসির কাছে আছে।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমি কয়েকদিন ধরে দেশের বাহিরে। গত এক সপ্তাহের মার্কেট সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা নেই। তবে শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যখন লাভ হবে বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করে দেবেন, আবার কম দামে পেলে কিনবেন। এটাই নিয়ম।
বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক বাড়তি দামে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা তিনি বলেন, মার্চেন্ট উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বের হয়ে গেছে, এমন অভিযোগ অনেকেই করে। ধরলাম মার্চেন্ট ব্যাংক শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে, সে যদি এখন বসে থাকে তাহলে তার প্রতিষ্ঠান চলবে কীভাবে। এগুলো মনগড়া কথা। লাভ হলে শেয়ার বিক্রি করে দিবে, আবার দাম কমলে কিনবে। এটা তো স্বাভাবিক কার্যক্রম।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যখন দাম বাড়ছিল তখনো আমি বলেছি, এটা থাকবে না। এখন বাজার সংশোধন হচ্ছে। এ কারণে লেনদেন কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় থাকলে হয়তো বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে নতুন নতুন আইপিও আসা অত্যন্ত জরুরি। তবে মানসম্পন্ন আইপিও খুব কম আসছে। বাজার ভালো শেয়ারের যোগান বাড়াতে হবে। ভালো শেয়ারের যোগান না বাড়ালে বাজার এমনই থাকবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের দরপতনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত। তবে আমরা বিএসইসির ওপর আস্থা রাখতে চায়। বিএসইসির চেয়ারম্যান সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে আমরা বিশ্বাস করি বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।